রাজা গৌর গোবিন্দ সিলেটে তার ইতিহাস

১৩১৩ খৃষ্টাব্দে রাজা গৌর গোবিন্দ সিলেটে ‘গৌর রাজ্য’ প্র্রতিষ্ঠা করেন। রাজা গৌর গোবিন্দ ছিলেন সাহসী যোদ্ধা এবং তিনি তন্ত্র সাধনায় বিশেষ প্রারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। রাজা গৌর গোবিন্দ ছিলেন গোড়া হিন্দু। অন্য ধর্ম বা জাতির প্র্রতি ছিলেন খুবই অশ্রদ্ধাশীল ও অসহিঞ্চু। কুটিল বুদ্ধিতে ছিলেন অসমকক্ষ। অত্যাচারী রাজা হিসাবে ছিলো সর্বশ্রেষ্ঠ। এ সময় বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় মুসলিম শাসন ও ওলী আওলিয়ারা ইসলাম প্র্রচার করতে থাকলেও সেখানে ইসলামের আলো প্র্রবেশ করেনি। তবে আর্শ্চয্যের বিষয় হলো, গৌর রাজ্যের ‘ঘর দুয়ার’ টিলা গড়ের টুলকিকর মহল্লায় ১৩ জন মুসলমান (অথবা ১৩ টি প্ররিবার) বাস করতেন। তারই একজন ছিলেন শেখ বুরহান উদ্দিন।

তিনি ছিলেন বেশ ধার্মিক। কিন্তু রাজা গোবিন্দের ভয়ে খুব গোপনে ইবাদত বন্দেগী করতেন। কেহই গরু জবাই করতেন না, কারণ গৌর গোবিন্দের রাজ্যে গরু জবাই ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শেখ বুরহান উদ্দিনের কোন সন্তান ছিল না। দীর্ঘদিন সন্তানের জন্য আকুল হয়ে অবশেষে তিনি আল্লাহর কাছে সন্তানের জন্য মানত করলেন। যদি তার একটি সন্তান হয় তাহলে তিনি আল্লাহর নামে একটি গরু কোরবানী করবেন। বেশ কিছুদিন অপেক্ষার পর অবশেষে সত্যি সত্যিই ঘর আলো করে এলো একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান।

আনন্দে আত্মহারা হয়ে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানালেন। অতপর মানত পুরণ করার লক্ষ্যে এবং আল্লাহর শোকরিয়া হিসাবে হিসাবে একদিন গোপনে একটি গরু কোরবানী করে মাংস গুলো মুসলমানদের মধ্যে বিলি করতে লাগলেন। এমন সময় একটি কাঁক এসে ছোঁ মেরে এক টুকরা মাংস নিয়ে গেলো। আল্লাহর কি খেলা, কাঁকটি মাংস টুকরাটি ফেললো রাজা গোবিন্দের রাজকীয় দেব মন্দিরের প্রধান প্রবেশ পথে। রাজা দেখেতো রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তার আদেশ অনুযায়ী সৈন্যরা বহু খোঁজাখুঁজির পর দেখলেন শেখ বুরহান উদ্দিনের বাড়ীতে গরু কোরবানী হয়েছে। রাজা আদেশে শেখ বুরহান উদ্দিনকে রাজার সামনে উপস্থিত করলো। বুরহান উদ্দিন ক্ষমা ভিক্ষা করলেও রাজা কিছুই ভ্রক্ষেপ করলেন না। শাস্তি স্বরূপ তার ডান হাত কেটে দিলেন। নিষ্পাপ কচি শিশুটিকে দেবতার সামনে বলি দিলেন। অবস্থা দেখে শিশুটির মা অর্থাৎ শেখ বুরহান উদ্দিনের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন আর ফিরে এলেন না, মৃত্যুর কোলে ঢলে প্ররলেন। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে বুরহান উদ্দিন গোপনে স্থান ত্যাগ করলেন এর । আর ওই দিনই রাজার লোকেরা আক্রমন চালিয়ে অন্য সব মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করলো।

এদিকে বহু কষ্ট করে বুরহান উদ্দিন প্রায়ে হেঁটে উপস্থিত হলেন সোনার গাঁয়ে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের দরবারে। ইলিয়াস শাহ সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। হলেন মর্মাহত ও ব্যথিত। একদিকে ইসলাম ধর্মের অবমাননা অপর দিকে নিষ্ঠুর অন্যায় অত্যাচার। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। রাজা গৌর গোবিন্দকে শাস্তি দেওয়ার জন্য অনেক সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধ করার জন্য। বেশ কিছুদিন যুদ্ধ হলো, শত শত মুসলিম সৈন্য শহীদ হলো । কিন্তু জয় করা হলো না। বুরহান উদ্দিনের কষ্ঠ, জ্বালা, যন্ত্রনা আরো বেড়ে গেলো।

কিন্তু শেখ বুরহান উদ্দিন থামলেন না। তিনি রওয়ানা হলেন দিল্লীর পথে। অনেক কষ্ঠ করে উপস্থিত হলেন দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ তুঘলকের সামনে। তিনি ছিলেন উদার, ন্যায় পরায়ণ ও ধার্মিক। তিনি বুরহান উদ্দিনের নিকট হতে সব বিষয় শুনে খুবই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। অতপর, গোবিন্দকে শায়েস্তা করার জন্য অনেক সৈন্য-সামন্তসহ সিকান্দার গাজীকে সেনাপতি করে অভিযানে পাঠিয়ে দিলেন।

কিন্তু পথিমধ্যে অনেক প্রতিকুলতা ও রোগ- বালাইয়ের কাছে সিকান্দার গাজী ব্যর্থ হয়ে আবার দিল্লীতে ফিরে গেলেন। সম্রাট পড়ে গেলেন ভীষণ চিন্তায়। অতপর নতুন কিছু সৈন্য সহ আর একজন বীর সৈয়দ নাসির উদ্দিন কে সেনাপতি নির্বাচন করলেন। তিনি ছিলেন অত্যধিক ধর্মপরায়ন, আমলদার ও সত্যবাদী ব্যক্তি। তিনি কখনও নামাজ ক্বাজা করতেন না। সম্রাটের আদেশ পেয়ে তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। ছুটে গেলেন তাঁর পীর হযরত খাজা নিজাম উদ্দিন (রঃ) এর দরবারে। তখন ওখানেই অবস্থান করছিলেন হযরত শাহ জালাল (রঃ)। সবকিছু শুনে হযরত শাহ জালাল (রঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সাথে এই অভিযানে যাবেন। অতপর হযরত শাহ জালাল (রঃ) তার ৩৬০ জন সহচর ওলীয়ে কামেল নিয়ে সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সৈন্যবাহিনীর সাথে আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা দিলেন। সিকান্দার গাজী তার সাথে সৈয়দ নাসির উদ্দিন ও হযরত শাহ জালাল (রঃ) কে পেয়ে অত্যধিক খুশী হলেন। এর ফলে সিকান্দার গাজী ও সৈয়দ নাসির উদ্দিনের প্রশিক্ষিত বাহিনী এবং ৩৬০ জন ওলীয়ে কামেলসহ হযরত শাহ জালাল (রঃ) আধ্যাতিক সাধনার সংমিশ্রণে তৈরি হলো একটি পরিপূর্ণ দল।

পতিমধ্যে গোবিন্দের সৈন্যদের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ওলীয়ে কামেলদের দোয়া, আল্লাহর সাহায্য সাহায্য এবং ব্যাপক সমর শক্তির নিকট গোবিন্দের তন্ত্র-মন্ত্র অকার্যকর হয়ে তার সৈন্যদের চরম পরাজয় হলো। নিহত হলো গোবিন্দের সেনাপতি মনা
রায়। এ খবর শুনে গোবিন্দ ভীত হয়ে গেলো। এদিকে মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হতে থাকলো রাজধানীর অভিমূখে। সুরমা নদী প্রার হয়ে রাজধানীর দিকে এগুতে থাকলো। রাজার সকল সৈন্য ভয়ে প্রালিয়ে প্রাণ বাঁচালো। মুসলিম বাহিনী প্রাসাদের নিকটবর্তী হলো। রাজা গৌর গোবিন্দ প্রাসাদ ছেড়ে এক দূর্গে আশ্রয় নিলেন। মুসলমানরা গৌর গোবিন্দের সুউচ্চ প্রাাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আযান দিতে লাগলেন। আযানের ধ্বনিতে গোবিন্দের সুউচ্চ প্রাসাদ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়লো। পতন হলো গৌর রাজ্যের।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লোকমান হেকিম নামের অর্থ কি জানেন

নিখোঁজ সিলেট এর দপ্তরী কাম প্রহরী মাহবুবুর রহমান এর মা তিন দিন থেকে